এস.এম.দেলোয়ার হোসাইন, শিবচর (মাদারীপুর) প্রতিনিধিঃ
মাদারীপুরের শিবচরের এক্সপ্রেসওয়েতে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৯ জনের পরিবার ও স্বজনদের আহাজারি থামছে না। এই দুর্ঘটনায় কারও মা, কারও বাবা ও কারও ছেলে চিরতরে চলে গেছেন পরপারে। তাঁদের জীবনের গল্প আলাদা। তবে তাঁদের হারিয়ে স্বজনদের সবার দুঃসহ বেদনা–কষ্টের অনুভূতি একই ধরনের। তাঁদের এভাবে চলে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের হাহাকার আর আর্তনাদে এক করুণ পরিবেশ সৃষ্টি হয় শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। রবিবার বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দূর-দূরান্ত থেকে স্বজনরা আসতে শুরু করেন হাসপাতালে। শনাক্তের পর বুঝে নিচ্ছেন স্বজনের লাশ। অ্যাম্বুলেন্সে করে রওনা দিচ্ছেন বাড়ির পথে।
রবিবার (১৯ মার্চ) সকাল সাড়ে ৭টার দিকে খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ইমাদ পরিবহনের বাসটি শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নিচে পড়ে যায়। এ সময় দুমড়েমুচড়ে যায় বাসটি। দুর্ঘটনায় শিবচরে ১৯ জন নিহত হয়।
নিহতরা হলেন ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার হিতোডাঙ্গা গ্রামের সৈয়দ মুরাদ আলীর ছেলে মো: ইসমাইল (৩৮), গোপালগঞ্জে র গপিনাথপুর গ্রামের তৌয়ব আলীর ছেলে হেদায়েত মিয়া বাহার(৪২),নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার কালনা গ্রামের বকু সিকদারের ছেলে ফরহাদ সিকদার(৩০),গোপালগঞ্জ সদরের শান্তি রঞ্জন মন্ডলের ছেলে অনাদী মন্ডল(৪২) নিহত অনাদি মন্ডল পরিবার পরিকল্পনার উপ পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন,গোপালগঞ্জে সরকারের বনগাও এলাকার সামচুল শেখের ছেলে মোস্তাক আহমেদ(৩০)।
গোপালগঞ্জ সদরের ছুটকা গ্রামের নশর আলী শেখের ছেলে সবজি শেখ, গোপালগঞ্জ সরদরের পাচুরীয়া গ্রামের মো: মাসুদের মেয়ে সুইটি আক্তার(২২), গোপালগঞ্জর টুঙ্গিপাড়া উপজেলার কাঞ্চন শেখের ছেলে মো: কবির শেখ,গোপালগঞ্জ সদরের আবু হেনা মস্তফার মেয়ে আফসানা মিমি(২০), গোপালগঞ্জ মোকসেদপুর উপজেলার আমজাদ আলীর খানের ছেলে মাসুদ খা(৩২), খুলনার সোনাডাঙার শেখা আহমেদ আলী খানের ছেলে শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন(৪২), খুলনার চিত্ত রঞ্জন মন্ডলের ছেলে চিন্ময় প্রসন্ন মন্ডল, খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার পরিমল সাধুর ছেলে মহাদেব কুমার সাধু, খুলনার টুটপাড়ার শাজাহান মোল্লার ছেলে আশরাফুল আলম লিংকন, সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার সখীপুর গ্রামের আমজেদ আলী সরদারের ছেলে রাশেদ সরদার, ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার অনন্তপুর গ্রামের আলী আকবরের ছেলে জাহিদের লাশের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়।
গোপালগঞ্জের সজীব শেখের মরদেহ শনাক্ত করেন তার ভাই ইমরান। ভাইয়ের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলার কসবা উপজেলার অনন্তপুর গ্রামের জাহিদ খানের মরদেহ শনাক্ত করেন ছেলে রাতুল খান। বাবাকে হারানো বেদনায় বারবার মূর্ছা যান তিনি।
গোপালগঞ্জ থেকে এসেছিলেন নিহত মোস্তাকের স্ত্রী জোনাকি বেগম। স্বামীর লাশ শনাক্তের পর নির্বাক হয়ে যান তিনি। দুই শিশু সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। মায়ের কান্নার সঙ্গে কাঁদছিল তারাও। আহাজারি করতে করতে বলছিলেন, ‘আমার সব শ্যাষ হইয়া গেলো। আমার ছোট ছোট দুই পোলারে এতিম কইরা ওনি চইল্লা গেলো। ওগো আমি কী বুঝ দিমু। আল্লাহ আমার মরণ দিলো না ক্যান? আমার স্বামীকে তোমরা ফিরাইয়া দাও।’
স্থানীয় বাসিন্দা রুহুল আমিন হক বলেন, ‘হাসপাতালে কান্না আর আহাজারি। শোকে স্তব্ধ চারপাশ। স্বজন হারানোদের কান্না আমাদেরও স্পর্শ করে গেছে। আশেপাশের অনেকেই হাসপাতালে ছুটে গেছেন দেখতে। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় স্বজন হারানোদের কান্নায় আমাদের চোখেও পানি চলে আসে। খুবই হৃদয় বিদারক!’
এদিকে রবিবার বিকালে শেষ হয় উদ্ধার অভিযান। শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিবুল ইসলাম জানান, বাসের মধ্যে আর কোনও মরদেহ না থাকায় বিকালে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয় উদ্ধার অভিযান। শিবচরে নিহত ১৭ জনের মধ্যে ১৬ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। স্বজনরা মরদেহ বুঝে নিয়েছেন। তবে সন্ধ্যার দিকে আরও একজনের মরদেহ তার স্বজনদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।